Is Boli an 18+ Web Series?
বাংলা ও আন্তর্জাতিক সিনেমা-সিরিজ রুচিবোধ সম্পন্ন। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া আমাদের সবারই একইরকম সিনেমা আর সিরিজ পছন্দ। এখানে এমন মানুষ হাতেগোনা, যারা নিয়মিত বাংলা সিনেমা দেখেন।
আমাদের দেশে কিছু বুদ্ধিজীবী আছেন, যারা বিশ্বের যাবতীয় অশান্তির মূল ধর্ম আর জাতীয়তাবাদ বলে মনে করেন এবং সারা বিশ্ব থেকে এই দুটো বিষয়ের বিলোপ চান। অবশ্য, তাদের এই বক্তব্য ফেসবুকে স্ট্যাটাস আর আড্ডায় গলাভারী কথা সর্বস্ব। যত যাই বলুন, সপ্তাহ শেষে এদেরই দেখা যায় সাদা ধবধবে পাঞ্জাবি আর সুগন্ধি আতর মেখে জুম্মার নামাজের একেবারে সামনের সারিতে বসতে। ছাব্বিশে মার্চ বা ষোলোই ডিসেম্বর এলে গর্বে বুক ফুলিয়ে হাঁটতে।
আমিও কিছুটা এই কিসিমের। পরিচিতজনদের সাথে জাতীয়তাবাদের কুপ্রভাব নিয়ে যতোই বড় বড় কথা বলি, দেশের কোনো অর্জনের কথা শুনলে গর্বে বুক ফুলে ওঠে। সেটা খেলাধুলা বা বিনোদন জগতের অর্জন, যাই হোক।
তেমনই দেশের কোনো সিনেমা বা সিরিজের প্রশংসা শুনলে তা দেখার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ি। এ প্রসঙ্গে ঢাকা অ্যাটাক, অজ্ঞাতনামা, আয়নাবাজি, জালালের গল্প, কন্টার্ক্ট, তাকদীর, মহানগর রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেন নি’র কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
বলা বাহুল্য, এগুলোর ভেতর অজ্ঞাতনামা আর মহানগর ছাড়া অন্য কোনোটিকে বেহিসেবী প্রশংসায় ভাসাতে পারি নি। সবার কটুক্তি শোনার ঝুঁকি মাথায় নিয়েই বলি, ‘আয়নাবাজি’-ও নয়।

হৈচৈয়ের মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। বরাবরের মতো বলির ক্ষেত্রেও তারা দুর্দান্ত প্রচারণা চালিয়েছে। ফেসবুকে তাদের প্রচারণার সূত্রেই প্রথম বলি সম্পর্কে জানি।
ট্রেইলারটা দেখেই আগ্রহী হই সিরিজটি দেখতে। মনে হয়েছিল এমন কিছু পেতে যাচ্ছি আমরা, যা আগের সবকিছুকে ছাড়িয়ে যাবে। এমনটা হলে তা হবে আমাদের জাতীয় অর্জন।
এবং, একটা সময়ে এসে দিন গুনতে শুরু করি, কবে দেখব বলি।
পূর্ব ঘোষণানুযায়ী তিন তারিখে রিলিজ হয়। আমরা তিন তারিখেই দেখি। যেহেতু একা দেখছিলাম না, প্রথমেই সেক্স আর ভায়োলেন্স সম্পর্কিত হৈচৈয়ের সতর্কবার্তা দেখে আমাদের বাঙালি মূল্যবোধে ঘা লাগে। দেখা বন্ধ করে দিই।
যার সাথে দেখছিলাম, তিনিও প্রাপ্তবয়স্ক। বলা বাহুল্য, তিনি আমার পিতৃতুল্য। ফলে, দেখব কি দেখব না, এ বিষয়ক একটি ছোট আলোচনা হলো আমাদের। শেষে এই সিদ্ধান্তে আমরা আসি, দুজনই যেহেতু প্রাপ্তবয়স্ক, আর যৌনতাকে মানুষের আর পাঁচটা স্বাভাবিক আচরণ হিসেবে দেখার মতো মানসিক পরিপক্বতা আছে, সেহেতু আমরা একসাথেই দেখতে পারি।
প্রথমে বলি বলি’র ইতিবাচক দিক:
বলি’র সব আলো কেড়ে নিয়েছেন শাহজাহান বলি, অর্থাৎ নাসির উদ্দিন খান। নাসির উদ্দিনের অভিনয় প্রথম দেখি মহানগরে। মূলত, তখনই তার অভিনয়ের প্রতি আমার ব্যক্তিগত মুগ্ধতার সৃষ্টি। এটুকু বললেও অত্যুক্তি হয় না, আমার বলি দেখার পেছনে তার নামটাও বড় ভূমিকা পালন করেছে।
কিছুদিন আগে কালের কণ্ঠে তার একটি সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম। সেখানে তিনি বলেছিলেন:
‘অভিনয় আর দুটো ভাত খাবো বলে ঢাকায় এসেছিলাম। এখন পর্যন্ত সে চেষ্টাই করে যাচ্ছি। জীবনে বহুবার চাকরির চেষ্টা করেছি। ৫-৬ বার চাকরি বদলেছি। শেষ পর্যন্ত আমি বুঝে গিয়েছি চাকরি আমার দ্বারা হবে না। আমি সব ছেড়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছি শুধু অভিনয়ের জন্য’
এই সাক্ষাৎকার পড়ার পর বলি’তে তার অভিনয় দেখে মনে হলো, একটা মানুষ যে অবস্থাতেই থাকুক, সে যা ভালোবাসে, তা নিয়ে পরিশ্রম করে গেলে সফলতা অবশ্যম্ভাবী।
বলি’র দ্বিতীয় যে জিনিসটি আমার ভালো লেগেছে, তা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। কাহিনির সাথে খাপে খাপ ছিল। সেইসাথে, টাইটেল সংটাও।
বলি’তে আমার তৃতীয় ভালো লাগার নামটি ছিল নিজাম বলি, অর্থাৎ জিয়াউল হক পলাশ। তার লুক দুর্দান্ত ছিল, সাথে অভিনয়ও। অবশ্য, কিছুকিছু জায়গায় তার অভিনয় খাপছাড়াও লেগেছে। সেসব ক্ষেত্রে মনে হয়েছে, ও একটা কিশোর, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার তীব্র সম্ভাবনা নিয়ে বেড়ে উঠলেও সতেরোয় এসে থেমে গেছে তার বয়স।
উদাহরণটা বোধহয় সার্থক হলো না।
এরকম বললে বোধহয় বুঝতে সুবিধা হবে, বলিতে নিজাম ছিল একটি আধফোটা ফুল।
চতুর্থ ভালো লাগার নাম ইরেশ জাকের। তার অভিনয়ও যথেষ্ট ভালো লেগেছে। তার যে চরিত্র, তা তিনি সাবলীলভাবেই ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। তবে, মূল রোল প্লে না করাতে তার প্রসঙ্গে এর চেয়ে বেশি প্রশংসা করা সম্ভব হলো না।
কেউ যদি আমার চতুর্থ ভালো লাগার পর পঞ্চম ভালো লাগার কথা জানতে মুখিয়ে থাকেন, তার কাছে করজোড়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করছি। লোকেশন ছাড়া আপনাকে খুশি করার মতো আর কোনো রসদ আমি পাই নি বলি’তে।
সুতরাং বুঝেই গেছেন,
এবার কথা বলব বলি’র নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ে।
প্রথমত, বলি’র কাহিনি যথেষ্ট দুর্বল। এখনকার ওয়েব সিরিজগুলোতে যেমনটা হয়–দর্শক টেনে ধরা, সেই ক্ষমতা বলি’র ছিল না। এমনকি, কিছু কিছু এপিসোড নিজেকে ফোর্স করে দেখতে হয়েছে। বেশিরভাগ অভিনেতা-অভিনেত্রীর অভিনয় ছিল গড়পড়তা, দুএকজনের কাঁচাও।
তাছাড়া, পতিতালয় কেন্দ্রিক যে প্লট ছিল, তার অনেকটাই মনে হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের সৃজিত মুখার্জি পরিচালিত সিনেমা ‘রাজকাহিনী’ থেকে মেরে দেয়া। বিশেষ করে, পতিতালয়ে বড় যে অ্যাকশন সীনটা থাকে, তা।
ট্রেইলারে বারবার চঞ্চল চৌধুরীকে দেখানোর পরও ইতিমধ্যে তার উল্লেখ করি নি বলে যারা বলি দেখেছেন বা দেখেন নি, দুই শ্রেণিরই ভ্রুকুঞ্চন হওয়ার কথা।
মূলত, চঞ্চল চৌধুরী সম্পর্কে বাংলাদেশীসুলভ মুগ্ধতা আমার নেই। কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছাড়া, বরাবরই তাকে আমার এভারেজ অভিনেতা মনে হয়েছে। সচরাচর তিনি যে অভিনয় করেন, তাই করেছেন বলিতে। তাই, যারা তার অভিনয়ে মুগ্ধ, তারা বলি’তে তার অভিনয় দেখে হতাশ হবেন না।
প্রথমেই সেক্স আর ভায়োলেন্স আছে বলে হৈচৈ একটি সতর্কবার্তার উল্লেখ করেছিল। যতই প্রগতিশীল হই, বাঙালিসুলভ সংস্কার কাটিয়ে ওঠা কি এতটাই সহজ ?
মনে মনে শঙ্কিত ছিলাম, কখন অ্যাডাল্ট সীন আসে আর কখন বিব্রত হতে হয়। কখন ভায়োলেন্স দেখাবে আর বুক ধড়ফড় করবে। গোটা বলি’তে অ্যাডাল্ট সীন বলতে প্রথম এপিসোডে রাখঢাক করা কয়েক সেকেন্ড ছিল আর ভায়োলেন্স বলতে কয়েকটি গুলির ক্ষত ছিল।
এসব দেখে প্রথমে দেখানো সেই সতর্কবার্তার কথা মনে পড়ল। “মশা মারতে কামান দাগানো” প্রবাদের এর চেয়ে সার্থক উদাহারণ আর হয় না।
এই লেখাটিকে প্রথম থেকেই রিভিউ হিসেবে না দেখিয়ে আমি আমার বলি দেখার ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছি। কতটুকু সফল বা ব্যর্থ হয়েছি, যারা পড়ছেন তারাই ভালো বলতে পারবেন।
যেহেতু এটা আমার ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া বলে আমি দাবি করছি, সেহেতু এখানে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার উল্লেখ বড় কোনো অপরাধ হিসেবে দেখা হবে না বলে আশা করি।
একবার এক ভয়াবহ ব্রেকাপ হয় আমার। সেই ব্রেকাপের ধকল সামলাতে পারছি না দেখে এক বন্ধু এলো আমাকে সান্ত্বনা দিতে। তাকে সান্ত্বনা দেয়ার কোনো সুযোগ না দিয়ে আমি কেবল অভিযোগের সুরে বলতে লাগলাম, “আমি ভেবেছিলাম ও এমন…, আমার মনে হয়েছিল ও তেমন, আমি ধারণা করেছিলাম ও যেমন…” জাতীয় প্রলাপ বকতে লাগলাম।
সব শুনে বড় একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেই বন্ধু দুই শব্দের একটি ইংরেজি বাক্য বলল। ভদ্রতাবোধের দিকে তাকিয়ে সে বাক্যের উল্লেখ করতে পারছি না এখানে। অবশ্য গুগলকে দায়িত্ব দিলে গুগল বাংলায় বাক্যটির অনুবাদ করবে এমন, “প্রত্যাশা সঙ্গম করে”।
এটুকু জানার পরও প্রকৃত বাক্যটি জানার জন্য অতিকৌতূহলী কারও মন উসখুস করতে পারে, কারও এমন হলে সে বাক্যটি “Expectation Fucks” ধরে নিয়ে নিজেকে শান্ত করতে পারেন।
ট্রেইলার, প্রচারণা, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দেখে বলি সম্পর্কে ভেবেছিলাম ভালো কিছু পেতে যাচ্ছি আমরা। তবে, বলি দেখা শেষে আমার সেই বন্ধুর কথা মনে পড়ল। আর তার সেই অমর উক্তি: প্রত্যাশা সঙ্গম করে…
পুনশ্চ-১: বলি এখনও যারা দেখেন নি ওপরের তথ্যগুলো তাদের স্পয়লার মনে হতে পারে। তাদের জ্ঞাতার্থে: বলি দেখার ক্ষেত্রে এসব তথ্য স্পয়লার হিসেবে কাজ করবে না বলেই সচেতনভাবে ততথ্যগুলোর উল্লেখ করেছি। সো, চিন্তার কিছু নেই।
পুনশ্চ-২: ধৈর্য ধরে পুরো লেখা পড়ার পরও প্রথম লাইনের প্রশ্নটার কারণ কী, তা বুঝতে না পেরে কাজি মারুফের মতো মনে মনে কেউ হয়তো বলতে পারেন, “সবার অংক মেলে, আমার অংক মেলে না”।
কেউ যদি কাজি মারুফের রোল প্লে করে থাকেন, তার অংক মেলানোর দায়িত্বটা আমিই নিলাম।
মূলত, বলি’র সাথে এই লেখার প্রথম লাইনের প্রশ্নটির কোনো সম্পর্কই নেই।
সারাদিন ফেসবুকে পড়ে থাকার পরও ফেসবুক ইউজাররা একেকজন দারুণ ব্যস্ত। ‘ধৈর্য্য’ শব্দটির সাথে ফেসবুকারদের যোজন যোজন দূরত্ব।
লেখাটি এমনিতেই বিশাল। ধৈর্য ধরে যে কয়জন পড়েছেন, তাদের পড়ার সম্ভাবনাও ছিল না।
একজন লেখক কোনো একটি লেখা অনেক কারণে লিখে থাকেন, তবে একটি কারণ প্রায় সব লেখকেরই থাকে। তাহলো, মানুষ তার লেখা পড়ুক। গড়পড়তা কিছুর চেয়ে নিষিদ্ধ কোনো কিছুর মানুষের অ্যাটেনশন গ্র্যাভ করার ক্ষমতা বেশি। আর আমাদের দেশের মানুষ ‘Sex’ শব্দটিতেই বিশাল এক নিষিদ্ধতার গন্ধ পায়।
ফলে, ফেসবুকে আপনাদের তীব্র ব্যস্ততা আর আমার আপনাদের নিজের লেখা পড়ানোর তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকেই প্রথমে লাইনটি হুদাই যুক্ত করে আপনাদের অ্যাটেনশন নেওয়ার মতো অসততা করতে হলো।